১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসির (OIC: Organization of Islamic Cooperation) ঐতিহাসিক সম্মেলনে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় তুরস্ক। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২৫ বছর উৎযাপনে আয়োজিত সিলভার জুবিলী অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিত অতিথিরা ছিলেন, বিশ্বখ্যাত নেলসন ম্যান্ডেলা, বিপ্লবী নেতা ইয়াসির আরাফাত এবং তার্কিশ প্রেসিডেন্ট সুলেমান ডেমিরেল। এই আয়োজনের পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৯৮ সালে তুরস্কের নেতৃত্বে মুসলিম প্রধান ৮টি দেশ নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক আর্থ- সামাজিক সংগঠন Developing 8 এ যোগ দেয় বাংলাদেশ।
 

২০১০ সালে তুরস্ক, তুর্কিয়ে বুরসলারি নামে নতুন শিক্ষা বৃত্তি চালু করার মাধ্যমে বিদেশি ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার জন্য নতুন দ্বার উম্মুক্ত করে দেয়। এই বৃত্তির আওতায় প্রতি বছর প্রায় ছয়-সাত হাজার বিদেশী শিক্ষার্থী পূর্ণ তহবিল বৃত্তিতে পড়ালেখা করার সুযোগ পায়। তুর্কি সরকারের বৃত্তির আওতায় শুধু পাসপোর্ট ও ভিসা খরচ ছাত্র নিজে দেয়, বাকি সব ব্যয়ভার তুর্কি সরকার বহন করে। ২০০৬ সালে তুরস্কে মাত্র ২০ জন বাংলাদেশী ছাত্র ছিলেন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা প্রায় ৫০০ ছাড়িয়েছে। এবং দিন দিন বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের সংখ্যাটি বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষার্থী ছাড়াও প্রচুর বাংলাদেশী ব্যবসা বানিজ্যের জন্য তুরস্কের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছেন।
 

তুরস্ক বাংলাদেশ সম্পর্কে সাময়িক শীতলতা আসে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময়। জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করার পরে, তুরস্ক বাংলাদেশ থেকে তাদের কূটনৈতিককে প্রত্যাহার করে। তবে এরদোগানের বিপক্ষে হওয়া মিলিটারি ক্যু এর বিপক্ষে বাংলাদেশের স্বপ্রণোদিত সোচ্চার অবস্থানের কারণে, বাংলাদেশ তুরস্কের কূটনৈতিক সম্পর্ক আবার আগের অবস্থানে ফিরে যায়। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে তুরস্কের নবনিযুক্ত কূটনৈতিক মিডিয়ায় বলেছিলেন যে,"Bangladesh had helped Turkey by expressing its support to Erdogan’s government after the failed coup attempt. Turkey is very interested in working with Bangladesh to curb militancy."
  

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে নয়া সৃষ্ট রোহিঙ্গা সংকটের সময় তুরস্ক বাংলাদেশের প্রতিদান যথাসম্ভব ফিরিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, যা তুরস্ক বাংলাদেশের সম্পর্ককে দিন দিন আরো গভীর করছে। এই দুঃসময়ে প্রচুর আর্থিক অনুদানের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তুরস্ক, যার একটি উল্লেখ্যযোগ্য প্রমাণ হলো, ২০১৭ সালে তুরস্কের ফার্স্ট লেডি আমিনে এর্দোগানের বাংলাদেশ ভ্রমণ এবং সরজমিনে রোহিঙ্গা সংকট পর্যবেক্ষণ।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত এই সফরগুলোতে বাংলাদেশে তুরস্কের উল্লেখ্যযোগ্য সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে এসেছিলেন, Mevlüt Çavuşoğlu, Minister of Foreign Affairs, Fatma Betül Sayan Kaya, Former Minister of Family and Social Policies, Recep Akdağ, Former Deputy Prime Minister, Binali Yıldırım, Former Prime Minister. এই সফরগুলোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী সহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সভার আয়োজন হয়েছিলো। ২০২১ সালে বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে আয়োজিত অনুষ্ঠান চলাকালে তার্কিশ প্রেসিডেন্ট এরদোগানের রেকর্ডেড ভিডিও বার্তাও চালানো হয়। সেসময় তিনি বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তিতে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের আমন্ত্রনে অনুষ্ঠানটিতে সরাসরি উপস্থিত না হতে পারায় দুঃখ প্রকাশ করেন। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে এরদোগান বাংলাদেশ সফরে আসবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।  
 

সামরিক কর্মসূচী হিসেবে বাংলাদেশ নেভীর একটি স্পেশাল ফোর্সকে ট্রেনিং এবং ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে ১১১টি অটোকার কোবরা নামক হালকা সাঁজোয়া যান বিক্রি করে তুরস্ক। দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে বাংলাদেশ এবং তুরস্কের এক বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা আছে। তুরস্ক বাংলাদেশের সাথে মুক্ত বানিজ্য চুক্তিতে যাওয়ার পাশাপাশি জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।

তবে বর্তমান বাংলাদেশে তুরস্ককে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ পরষ্পরবিরোধী দুইটি রাজনৈতিক শ্রেণীর উত্থান হয়েছে। একটি শ্রেনী ডানপন্থী সেক্যুলার ভাবধারা থেকে তুরস্ক সরকারের যুদ্ধপরাধীদের পক্ষে নীতি অবলম্বন করাকে কখনো মেনে নিতে পারেনি, আবার আরেকটি পক্ষ হারানো খিলাফত ও মুসলিম বিশ্বের অগ্রসর সুন্নি সামরিক শক্তি হিসেবে তুরস্কের যেকোনো নীতির কট্টর সমর্থক। নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, অর্থনীতিতে তুরস্কের প্রতিনিয়ত অসন্তোষজনক অবস্থানের বিপরীতে, মুসলিম বিশ্বে ক্রমশ দেশটির প্রভাব এবং গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। 


আশরাফুল আলম প্রান্ত
ইতিহাসনামা.কম এর তিনজন সহ-প্রতিষ্ঠাতার একজন। অতিরিক্ত স্বপ্ন দেখতে গিয়ে সময় অপচয় করা তার মুদ্রা দোষ।