দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: ফলাফল ও প্রভাব
১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর হিটলারের জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দীর্ঘ ৬ বছর স্থায়ী ছিলো (১৯৩৯-১৯৪৫)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পৃথিবীর শক্তিশালী রাষ্ট্র গুলোর দু'ভাগে বিভক্ত ছিলো। অক্ষশক্তি ও মিত্রশক্তি।
অক্ষশক্তি: জার্মানি, ইতালি, জাপান
মিত্রশক্তি: ব্রিটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন
যুদ্ধের শুরুর দিকে জার্মানির তথা অক্ষশক্তির একের পর এক দেশ দখল করার মাধ্যমে প্রবল প্রতাপে জয়যাত্রা চলছিলো। তবে ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবারে বিমান হামলা চালিয়ে বিশাল নৌ ও বিমান ঘাঁটি ধ্বংস করার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে আসে। এর পরবর্তী সময়ে যুদ্ধে মিত্রশক্তির সম্মিলিত আক্রমণে একের পর এক পরাজয় হতে থাকে জার্মানি ও ইতালির। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে জার্মানি ও ইতালি মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। হিটলার আত্মহত্যা করেন আর মুসোলিনিকে গ্রেফতার করে হত্যা করা হয়।
অন্যদিকে ১৯৪৫ সালের ২ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন, পটাসডাম সম্মেলনে জাপানকে আত্মসমর্পণ করতে বললে জাপান তা প্রত্যাখ্যান করে। পরে ৬ ও ৯ আগস্ট হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমাবর্ষণ করা হয়। ফলে ১৪ আগস্ট জাপান শর্তহীনভাবে আত্মসমর্পণ করে। সমাপ্ত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পর বিশ্ব রাজনীতিতে সুদূর প্রসারী ফলাফল আমরা প্রত্যক্ষ করি। নিচে তা নিয়ে আলোচনা করা হলো,
১) সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের বিকাশ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সারা পৃথিবীতে দুটি ভাগ লক্ষ্য করা যায়। সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী দেশ। এছাড়া ইউরোপও দুই ভাগে ভাগ হয়ে পশ্চিম ও পূর্ব ইউরোপ হয়। পশ্চিম ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্র বলয়ের পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে। অন্যদিকে পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ধাঁচের সমাজতন্ত্র বিকশিত হয়।
২) উপনিবেশবাদের অবসান: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনসহ অন্যানা বৃহৎ সাম্রাজ্যের পতন হতে থাকে। শুধু ব্রিটিশ সাম্রাজ্য হতেই ৫৭টি দেশ যুদ্ধপরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা লাভ করে। ঔপনিবেশিক শাসনের দেশগুলো কি পরিমানে স্বাধীন হতে থাকে তা অনেকখানি বোঝা যায় এই পরিসংখ্যান থেকে। ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র ছিল ৩৫। ১৯৭০ সালের মধ্যে তা ১২৭ এ গিয়ে পৌঁছেছিল।
৩) জার্মানির বিভক্তি: হিটলারের পতনের পর জার্মানি দু'ভাগে বিভক্ত হয়। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৪৯ সালের ২৩শে মে পশ্চিম জার্মানির ও ৭ অক্টোবর পূর্ব জার্মানির আত্মপ্রকাশ ঘটে।
৪) তৎকালীন বৃহৎশক্তি ফ্রান্স ও বৃটেনের পতন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনের বিশ্বব্যাপী তার সম্রাজ্য হারায়। বৃটেনের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে ও বিশ্ব বাজারে পণ্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে স্থল ও নৌ বহর হ্রাস করতে হয় তাদের যা তাদের সামরিক শক্তি খর্ব করে ফেলে। ফ্রান্সের অবস্থা বৃটেনের থেকে অনেক গুণে খারাপ বলে ধরা হয়। ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ও শিল্প ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা ও ধর্মঘট ফ্রান্সকে প্রায় ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে। শুধু এসময়ে ১৯৪৬-১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ১৪ জন প্রধানমন্ত্রী একে একে ক্ষমতায় এসে চলে যেতে বাধ্য হন।
৫) নতুন বৃহৎশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান: ফ্রান্স ও বৃটেনের দুরবস্থার সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রভাব বিস্তার শুরু করে। উভয় দেশেরই ছিল প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ ও সামরিক শক্তি। এর ফলে এ দুই দেশের প্রভাব বিস্তার অব্যাহত থাকে সেসময়। যা পরবর্তীতে তাদের নতুন পরাশক্তি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়।
আরো পড়ুনঃ ঠাকুর পরিবারের নিঃসঙ্গ নক্ষত্র
৬) স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা: বিশ্বযুদ্ধের পরে গোটা বিশ্বে মেরূকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজ নিজ প্রভাব বলয় সৃষ্টি করে। উভয় দেশেরই পারমাণবিক শক্তি থাকায় দুই রাষ্ট্রই আতঙ্কিত বোধ করে। ফলে দেখা দেয় এক ধরনের যুদ্ধের যা কিনা “স্নায়ুযুদ্ধ” হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত। তবে ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত পূর্ব ইউরোপের নিয়তি নিয়ে দুই রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বই স্নায়ু যুদ্ধের সূচনা করে বলেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মত। স্নায়ুযুদ্ধ ১৯৪০ এর দশক থেকে ১৯৮০ র দশকের শেষ পর্যন্ত ছিল |
৭) গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রসার: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের ভয়াবহ রূপ দেখে পরবর্তীতে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রসারণ শুরু হয় |
৮) জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা: ১৯৪১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল আটলান্টিক মহাসাগরে “অগস্টা যুদ্ধজাহাজে” আটলান্টিক সনদপত্র স্বাক্ষর করেন। যা বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সংস্থার ইঙ্গিত দেয়। ১৯৪২ সালে এ সনদে আস্থাজ্ঞাপনকারী ২৬টি দেশের সম্মেলনে সর্বপ্রথম “জাতিসংঘ" কথাটি ব্যবহার হয়। ১৯৪৫ সালে সানফ্রান্সিসকো সম্মেলনে জাতিসংঘ সনদ গৃহীত হয়। ২৪ অক্টোবর, ১৯৪৫ সনদ চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। প্রতিষ্ঠা পায় জাতিসংঘ।
৯) ফ্যাসিবাদের বিলুপ্তি: বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি জয়ী হওয়ায় ফ্যাসিবাদকে চিরতরে বিলুপ্ত করা হয়।
১০) পারমাণবিক শক্তির উত্থান: বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নয়টি দেশ-চীন, উত্তর কোরিয়া, ফ্রান্স, ভারত, পাকিস্তান, ইসরাইল, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়। ধারণা করা হয় বর্তমানে এসব দেশের কাছে প্রায় ১৪,০০০ পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ আছে।
আরো পড়ুন:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: একটি রক্তাক্ত ইতিহাসের কারণ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা যদি অ্যানিমের মাধ্যমে জানতে চান
শ্বেত মৃত্যু: ইতিহাসের সর্বাধিক কিল রেকর্ড যে স্নাইপারের