ঠাকুরবাড়ির নিঃসঙ্গ নক্ষত্র - খালিদ আল হাসান (স্বাক্ষর)
ঠাকুরবাড়িতে কখনও ‘জ্যোতিদাদা’ আবার কখনো 'নতুনদাদা' নামে পরিচিত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ৪ঠা মে, ১৮৪৯ সালে। তিনি ছিলেন দেবেন্দ্রনাথের পঞ্চম পুত্র।তার জন্মের সাত মাস পরে ২১শে ডিসেম্বর ১৮৪৯, দেবেন্দ্রনাথ গিরীন্দ্রনাথ-সহ ২১ জনকে নিয়ে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন।তাঁর বাল্যস্মৃতিতে ঠাকুরবাড়িতে দেখা দুর্গোৎসবের উল্লেখ আছে। দেবেন্দ্রনাথ সেসময় বাড়িতে থাকতেন না।পুজো সামলাতেন তাঁর দুই ভাই গিরীন্দ্রনাথ ও নগেন্দ্রনাথ।জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বয়স যখন ১০, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরবাড়িতে দুর্গোৎসব বন্ধ করে দেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ভাষায়, “আমাদের সাবেক চণ্ডীমণ্ডপ ব্রহ্মমণ্ডপে পরিণত হল।”
এরপরই গিরীন্দ্রনাথের পরিবার আলাদা হয়ে দ্বারকনাথের বৈঠকখানা বাড়িতে পূজাপাঠের ব্যবস্থা করলেন। দেবেন্দ্রনাথের পরিবার মূল বাড়িতে রয়ে গেলেন। গিরীন্দ্রনাথের পরিবারে দোল, দুর্গোৎসব প্রভৃতি সব ধরনের হিন্দু পৌত্তলিক রীতিনীতি পালিত হত।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ইংরেজি শিক্ষা শুরু হয় সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথের কাছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মনে হত ‘তিনি যেন জেলখানায় আছেন,সমস্ত জগৎ ব্রহ্মাণ্ড তাঁহার নিকট অন্ধকার। যদিও হেমেন্দ্রনাথ শিক্ষক হিসেবে খুব কড়া ছিলেন।কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনে সত্যেন্দ্রনাথ ও হেমেন্দ্রনাথ বিশেষ ছাপ ফেলেছিলেন। এঁরা জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে এক দিকে যেমন ব্যায়াম, কুস্তি, সাঁতার শিখতে উৎসাহিত করেন, তেমনই নাট্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, বিজ্ঞানশিক্ষা, ভাষাশিক্ষা ইত্যাদির দিকেও ঠেলে দিয়েছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কথায়, “ব্রাহ্মধর্মের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাড়িতে একটা জ্ঞানের ঢেউ এসেছিল; পিতৃদেবের জ্বলন্ত ব্যাখ্যান, মেজদাদার মনোহর ব্রহ্ম-সংগীত, বড়োদাদার গভীর তত্ত্ববিদ্যা ও অনুপম স্বপ্নপ্রয়াণ, জ্ঞানধর্মের আলোক বিস্তার করেছিল।”
সেজদা হেমেন্দ্রনাথের পর তিনি সেন্ট পল্স স্কুল, মন্টেগুস অ্যাকাডেমি ও হিন্দু স্কুলে পড়াশোনা করেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনের প্রথম পোর্ট্রেট আঁকেন লর্ড সিনহার পিতৃব্য প্রতাপনারায়ণ সিংহের মণিরামপুরের বাড়িতে বসে।
হিন্দু স্কুলের পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ভর্তি হন ক্যালকাটা কলেজে। এখান থেকেই ১৮৬৪ সালে দ্বিতীয় বিভাগে এন্ট্রান্স পাশ করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে কিছু দিন পড়ার পরে তিনি আনুষ্ঠানিক ছাত্রজীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। তারকনাথ পালিতের অনুরোধ উপেক্ষা করে তিনি দাদা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে মুম্বই পালিয়ে যান। তবে স্কুল ছাড়লেও পড়াশোনা তিনি কখনও ছাড়েননি।সাহিত্য, সঙ্গীত ও চিত্রকলার অফুরান জগতের সন্ধান পান। খুব অল্প দিনের মধ্যেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র শিখে বাজাতে শুরু করেন। সঙ্গীতের জগতে তাঁর প্রবেশ ঘটতে থাকে। তাঁর বাজানো সেতার, হারমোনিয়াম বা পিয়ানো শুনে সকলে মুগ্ধ হয়ে যেত। ব্রাহ্মসমাজে গানের সঙ্গে হারমোনিয়াম বাজানোর ভার জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে দেওয়া হয়। দেবেন্দ্রনাথের উৎসাহে পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনে ঠাঁই পেত সংস্কৃতির নিত্য-নতুন চর্চা। কখনও কবিতা, কখনও গান আবার কখনও নাট্যচিন্তা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর না থাকলে বাঙালি গীতা-রহস্যের হদিশ পেত না। সংস্কৃত নাটকের বিপুল ভাণ্ডার অধরাই থেকে যেত। বঞ্চিত থাকত পাশ্চাত্য সাহিত্যের রস আস্বাদন থেকে। নিজের অন্তঃপুরিকা স্ত্রী কাদম্বরীকে চিৎপুরের রাস্তা দিয়ে ইডেন গার্ডেনসে ঘোড়া ছুটিয়ে নারী স্বাধীনতা সম্বন্ধে সচেতন করেছিলেন।বিদ্বজ্জন সমাগম, সঞ্জীবনী সভার মাধ্যমে তিনি সাহিত্যসেবার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। আর সেই সঙ্গে গড়ে দিয়েছিলেন বাঙালির গর্বের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করতেন। ১৮৬৮ সালের জুনে কর্মসূত্রে তিনি ‘বোম্বাই’ চলে গেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ ও হেমেন্দ্রনাথের সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথও ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করতে শুরু করেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, "তখন বড়ো বড়ো গায়কদিগকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আশ্রয় দেওয়া হইত।” এঁদের মধ্যে রমাপতি বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজচন্দ্র রায় ও যদু ভট্টকে তিনি পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘মেন্টর’ যদি কেউ থেকে থাকেন, তিনি হলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।জোড়াসাঁকোর বাড়ির তেতলার ঘরে রবীন্দ্রনাথের কবিপ্রতিভাকে হঠাৎই একদিন আবিষ্কার করেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। তাঁর থেকে বারো বছরের ছোট ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের রূপ ছিল দেখার মতো। একবার চোখের দেখা দেখবেন বলে রসরাজ অমৃতলাল বসু অপেক্ষা করে থাকতেন প্রেসিডেন্সি কলেজে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের আগমনের আশায়। প্রতিভার দীপ্তি চেহারায় প্রকাশ পেত। রবীন্দ্রনাথের আগে দেবেন্দ্রনাথের সব থেকে সম্ভাবনাময় সন্তান ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।
‘জোড়াসাঁকো নাট্যশালা’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথেরই সৃষ্টি। প্রথমেই মধুসূদনের ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক অভিনীত হল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সেই নাটকে কৃষ্ণকুমারীর মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করে প্রশংসা পান। নাটকের খোঁজ করতে তিনি ও আরও চার জন— কৃষ্ণবিহারী সেন, গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয় চৌধুরী ও যদুনাথ মুখোপাধ্যায় মিলে গড়লেন ‘কমিটি অব ফাইভ’ বা ‘পঞ্চজন’ সমিতি। ছিল একটি ‘ইটিং ক্লাব’ও। সেখানে লুচি-কচুরি খেতে খেতে জোড়াসাঁকো নাট্যশালা গড়ার ভাবনা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মাথায় আসে।জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বাড়ির মেয়েদের ইংরেজি গল্প-উপন্যাস বাংলায় অনুবাদ করে শোনাতে শুরু করেন। স্বর্ণকুমারী দেবীর আত্মপ্রকাশের প্রক্রিয়া শুরু হয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের চেষ্টাতেই।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনে আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ‘সঞ্জীবনী সভা’ স্থাপন। স্থাপনের পিছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল ইতালির ‘কারবোনারি’ গুপ্ত বিপ্লবী সংস্থা। কলকাতার ঠনঠনিয়ায় এক পোড়ো বাড়িতে এই গুপ্ত সভা বসত। সভার অধ্যক্ষ ছিলেন রাজনারায়ণ বসু। কিশোর রবীন্দ্রনাথও সভ্যদের একজন ছিলেন। এই সভা যখন বসত, টেবিলে একটি মড়ার খুলি রাখা থাকত। খুলিটির চোখের কোটরে বসানো হত দু’টি মোমবাতি। খুলিটি মৃত ভারতবর্ষ ও মোমবাতি দু’টি ছিল ভারতের প্রাণ সঞ্চার ও জ্ঞানচক্ষু ফুটিয়ে তোলার সংকেত! ১৮৭৪ সালে তিনি লেখেন ‘পুরুবিক্রম’ নাটক। ১৮৭২ সালে কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠা করেন ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ’। এই নতুন সমাজ স্ত্রী স্বাধীনতার উপরে জোর দেয়। ব্যাপারটা তখন অনেকের কাছে ‘কিঞ্চিৎ আতিশয্য’ বলে মনে হয়েছিল। সেই আতিশয্যের প্রতি কটাক্ষ করে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লেখেন তাঁর প্রথম একাঙ্ক প্রহসন ‘কিঞ্চিৎ জলযোগ’।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ স্ত্রী স্বাধীনতার প্রতি আকৃষ্ট হন সত্যেন্দ্রনাথের বিদেশ থেকে ফিরে আসার পরে। নিজেই জানিয়েছেন, “সেজদা বিলাত হইতে ফিরিয়া আমাদের পরিবারে যখন আমূল পরিবর্তনের বন্যা বহাইয়া দিলেন তখন আমারও মতের পরিবর্তন ঘটিয়া ছিল। তখন হইতে আমি অবরোধ প্রথার পক্ষপাতী নহি, বরং একজন সেরা নব্যপন্থী হইয়া উঠিলাম।”
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জাহাজ ব্যবসাতে মনোনিবেশ করতে চেয়েছিলেন।কিন্তু ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের কারনে সে ব্যবসা মার খেয়ে যায়।এর পরে দেবেন্দ্রনাথ জমিদারি দেখাশোনার কাজে নিযুক্ত করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে। কলকাতা ছেড়ে তাঁকে যেতে হয় কটক ও শিলাইদহে। এই পর্বেই তিনি লেখেন ‘পুরুবিক্রম’ নাটক।
জোড়াসাঁকোর তেতলার ছাদের ঘরে তখন থাকতেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী। ঘরের লাগোয়া লম্বা ছাদ। সেই ছাদে তৈরি করা হয়েছিল বাগান। ঘরে ছিল একটি গোল টেবিল। দেওয়ালের গায়ে পিয়ানো রাখা। সেই টেবিল ঘিরে বসতেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, অক্ষয় চৌধুরী, বালক রবীন্দ্রনাথ।
সরোজিনী’র পরে অশ্রুমতী,স্বপ্নময়ী। তার পরেই মৌলিক নাটক লেখা থামিয়ে দেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। অমৃতলাল বসুকে জানিয়েছিলেন, “নাট্যজগতে গিরিশচন্দ্র প্রবেশ করিয়াছেন, আমার নাটক রচনার আর প্রয়োজন নাই।” নাটক ছেড়ে তিনি মেতে ওঠেন অনুবাদ কর্মে। সংস্কৃত, মরাঠি, ইংরেজি, ফরাসি থেকে অনুবাদ করতে শুরু করেন। কালিদাস, শূদ্রক-সহ বিরাট সংস্কৃত সাহিত্য ভাণ্ডারে সঙ্গে তিনি বাঙালির পরিচয় করিয়ে দেন। চার বছরে সতেরোটি নাটক অনুবাদ করেন। একটি ব্রহ্মদেশীয় নাটকও বাংলায় অনুবাদ করেন। বাল গঙ্গাধর তিলকের ৮৭২ পৃষ্ঠার মহাগ্রন্থ ‘গীতা রহস্য’ বা ‘কর্মযোগশাস্ত্র’ অনুবাদ তাঁর জীবনের এক প্রধান কীর্তি।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের আর এক অক্ষয় কীর্তি বাংলায় আকারমাত্রিক স্বরলিপির সহজ পদ্ধতির আবিষ্কার। যা ছাপা ও পড়ার সুবিধে করে দিয়ে সঙ্গীত সাধনাকে মানুষের আয়ত্তে এনেছিল।জ্যোতিরিন্দ্রনাথের একটি ছদ্মবিজ্ঞান জানা ছিল। তা হল ‘ফ্রেনোলজি’ বা ‘শিরোমিতি-বিদ্যা’। তার আঁকা ১৮০০ স্কেচ সংরক্ষিত আছে আজও। রবীন্দ্রনাথ ও রোদেনস্টাইনের উদ্যোগে ১৯১৪ সালে এই স্কেচগুলি নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়।
এমন আশ্চর্য গুণের অধিকারীর জীবন হঠাৎই থমকে যায় কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পর। কাদম্বরীর মৃত্যু ‘সৃষ্টিসুখের উল্লাসে’ মেতে থাকা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীলতার কফিনে পেরেক ঠুকে দেয়।১৮৯৮ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘ভারত সঙ্গীত সমাজ’-এর কাজকর্ম শেষ হওয়ার মাধ্যমে তিনি কর্মজীবন থেকে অবসর নেন।
১৯০৮ সালে রাঁচির মোরাবাদী পাহাড়ের উপরে ‘শান্তিধাম’ বানিয়ে চিরদিনের মতো জোড়াসাঁকো থেকে চলে যান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। ১৯২৫ সালের ৪ঠা মার্চ সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর সঙ্গী ছিল শুধুই এক অন্তহীন শূন্যতা।
তথ্যসূত্র:
১/ রবীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, মাহবুবুল হক, মূর্ধন্য প্রকাশনী, (২০১২),(পৃষ্ঠাঃ৬-৮,১৬-১৭,৩৪-৩৮,৪৫-৪৯)।
২/ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি: নাট্যচর্চা ও বিবিধ প্রসঙ্গ, মুহম্মদ শফি, এশিয়া পাবলিকেশন্স,ঢাকা, ২০১৫,(পৃষ্ঠাঃ২১-২২)