বাসা থেকে কিছুক্ষণ আগে বেড়িয়েছে সাকিব। বেশ সকাল। কেবল মাত্র সকাল সাতটা বাজে। এত সকালেও রাস্তার কুকুরগুলো রাস্তার কোণায় শুয়ে সাকিবের দিকে ঘুমন্ত চোখ নিয়ে মাথা উচু করে তাকাবার চেষ্টা করে। তারা হয়তো সাকিবকে মনে মনে শুভ সকাল জানালো।

এত সকালেও রাস্তায় তাদের মতো যুবকদের হাটাচলার ভীর কমে নি। সাকিবের মতো অনেকেই এরকম এত সকালে বের হয় কেউ চাকরির খোজে, কেউ যাতায়াত করছে ঠেলে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে বাস ধরছে। প্রত্যেকদিন এরকম সকালে কিছু ছেলেরা এসে ফুটপাতের দেয়ালে নতুন খবরের পাতা আঠা দিয়ে লাগায়।  তারা সাকিবকে চেনে। খুব ভালো করেই চেনে, কারণ সাকিব প্রত্যেকদিন একই সময়ে সাকিব মতিঝিলের এই ফুটপাতে এসে নতুন পত্রিকার দেয়ালগুলোয় চোখ বোলায়। মাঝে মধ্যে কিছু চাকরির পত্রিকায় কোনো বিজ্ঞপ্তি পেলে সেটা সে নিজের পকেটে থাকা সাদা কাগজ বের করে লিখে নেয়। সাকিব চাইলে পত্রিকার দরকারী অংশ ছিড়ে নিতে পারে। কিন্তু সাকিব এটা করবে না। সাকিব সব কর্মের মানুষকেই সম্মান করে। সে জানে যেসব ছেলেগুলো খুব সকালে উঠে পত্রিকা দেয়ালে লাগায় তারা খুবই খেটে খাওয়া কস্টে থাকা মানুষ। তাদের এই ছোট কাজের কারণে তার একটা বড় উপকার হতে পারে বলে সাকিব তাদের সম্মানের চোখেই দেখে। 

আজকে ছেলেগুলো এখনো এসে নতুন পত্রিকা লাগায় নি। দেয়ালে এখনো সেই গতকালের পত্রিকা লাগানো। খানিকটা ছেড়া ছেড়া। আশপাশ দিয়ে মানুষ পানের পিক ফেলে পত্রিকার আধা অংশ নস্ট করে দিয়েছে। 
সাকিবের ইচ্ছা করছে ছেলেগুলো আসার আগ পর্যন্ত কালকের পত্রিকা গুলো আরেকটু ঘেটে দেখলে কেমন হয় কিন্তু তা আর ইচ্ছে হলো না। অতীতের জিনিস অতীতেই যখন হারিয়ে গিয়েছে তাহলে আর অতীতকে বর্তমানে এনে জগাখিচুরি বানানোর দরকার নেই। তার চেয়ে বরং সাকিবের মন বলছে‘ বর্তমানের পিছনে ছুটে চলো বেকার পথিক’ ।

সাকিব জায়গাটা থেকে সামনে যেতেই পিছন থেকে আলীম চাচার ছোট দোকান থেকে একটা ডাক এলো, “ মামা আজকে চা খাইবেন না? কালকের পাঁচ টাকা তো আজকা দেবার কথা আছিলো। ”
সাকিব মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতে বাধ্য হয়। তারপর গিয়ে দোকানের ভিতরের বেঞ্চে গিয়ে বসে। 
সাকিব বলল, “ সকাল থেকে এখনো কিছুই খাই নি। চা খেয়ে কি পেট ভরবে?” 
আলীম চাচা এক গাল পান খাওয়া হাসি দিয়ে বলল,“ এক্কেরে খাটি কথা কইসেন মামা। নেন একখান পাউরুটি আর এক কাপ গরম চা দিতে আছি। ”
সাকিব বলল, “ আলীম চাচা,  চায়ে চিনিটা বেশি দিলে কি আপনার লোকসান হবে? ”
আলীম চাচা বলল, “ এটা কি কইলা মামা। আপনি হইলেন আমার নিয়মিত কাস্টমার। আপনার খুশি করা আমার দায়িত্ব। লোকসান হইবো কেন? লাভ হইবো! আপনে খাইবেন টাকাও দিবেন। তাইলে লাভই তো হইলো। ” 
সাকিব কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ালো। 

আলীম চাচা চা বানাতে বানাতে সাকিবকে জিজ্ঞেস করল, “ মামা আপনি যে প্রত্যেকদিন  এত সকালে বাইর হন কোনো বড়-সড় চাকরি করেন নাকি?”
সাকিব বলল,“ না এখনো চাকরি জোটে নি। খুজছি, পাচ্ছি হলেও হচ্ছে না। ” 
আলীম চাচা দার বের করে হেসে বলল, “ বুঝতে পারসি। নেন চা আর পাউরুটি। সব মিলাইয়া ১৫ টাকা মামা আর কালকের পাচ টাকা। ২০ টাকা দেন” 
সাকিব অবাক চোখে বলল, “ ২০ টাকা? " 
“ আচ্ছা পাচ টাকা কম দিয়েন। ” 
“ চাচা আমি দশটাকা দিচ্ছি কাল মোট ১০ টাকা দিব নে। ”

আলীম চাচা কোনো কথা বললেন না। চেহারা ভঙ্গিতে আবছা রাগ ভাব দেখা গেলেও আলীম চাচা চুপ করে কাস্টমারদের জন্য চা বানাতে হাত দিলেন।দোকানে মাত্র কয়েকজন তার মতো যুবক এসেছে। এতক্ষণে দোকানে অনেকে এসেও পড়েছে। সবাই দেখতে সাকিবের মতোই যুবক। কারোর হাতে সাকিবের মতো একটা হলুদ নীল ফাইল। কালো প্যান্ট সাদা শার্ট বা অনেকের নীল শার্ট। বেঙ রঙা পোশাকে আজ পর্যন্ত সাকিব কাউকে এই ছোট চায়ের দোকানের আশে পাশেও দেখে নি। 
সাকিব জানে আলীম চাচা তাকে উঠে অন্যদের বসার জায়গা করে দিতে বলবেন। তাই সাকিব আর দেরি করল না বলবার আগেই উঠে গিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল। আসার সময় মনে হলো আলীম চাচা তাকে নির্দিষ্ট করে অন্যলোকদের বলল ‘ফকিরের আবার ফুটানি কত!’
সাকিব কথাগুলো দ্বিতীয়বার শোনবার চেষ্টা করলো না।

সাকিব আলীম চাচার বেশি বকবকানি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। সাকিব মাথা ঘামাচ্ছে খাবারের বিল নিয়ে। গতকাল সকাল বারোটার দিকে একটু চা খাবার শখ জাগলো। তারপর আলীম চাচার চা খেয়ে সাথে কয়েক পিস বিস্কুট খেয়ে যেই বিলটা এলো সাকিব শুনে প্রায় আকাশ থেকে মাটিতে পড়লো যেন। তবুও পাঁচ টাকা বাকি রাখা ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না। কিছু করার নেই সাকিবের। সাকিব দীর্ঘদিন ধরেই বেকার। 

সাকিব হাতে হলুদ ফাইল নিয়ে এখনো মতিঝিলের রাস্তার ফুটপাত দিয়ে হাটছে আর দেয়ালে তাকাচ্ছে। সবই কালকের কাগজ লাগানো। নতুন কোনো চাকরির বিজ্ঞপ্তির কাগজ নেই। সামনের ফুটপাতে মনে হলো একটু ভির বেড়েছে। ভির বলতে সেখানে মানুষের হাটাচলা বেশি দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে।  বিশেষ করে হকারগুলো বসে থাকলেও ফুটপাতে এত মানুষ এসে ঝোক লাগায় না। যতটা ঝোক লাগায় দেয়ালের নতুন পত্রিকা আর চাকরির বিজ্ঞপ্তি নিয়ে। তারপর দেয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোয়া উড়ানো আর হাতে চা নিয়ে সময় নস্ট করেই চলেছে মানুষ। তখন দেখলে ঝোক লেগেছে বলে মনে হয় কিন্তু তেমন কিছুই না।

সাকিব পৌছাতে জায়গাটা খালি হতে শুরু করেছে। সত্যি সত্যি একটা কাগজ ছাপানো হয়েছে মাত্র। আজকের পত্রিকা। সাথে রয়েছে পাঁচ পৃষ্ঠার চাকরির বিজ্ঞপ্তি। সাকিব দেয়ালের সামনে গিয়ে দাড়ালো। তার পাশেই এক বোরকা পড়া মেয়ে দাড়িয়েছে সাথে। সাকিব এরকম কোনো মেয়ে মানুষকে এভাবে দাঁড়িয়ে পত্রিকা ঘাটতে দেখে নি। 
পত্রিকা পড়া শেষে বোরকা মেয়েটা সাকিব বলল, “ এক্সকিউজ মি?"
সাকিব ডানে তাকালো। মেয়েটা একটা ছোট কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল, “ আমাকে দয়া করে নাম্বারটা একটু লিখে দিবেন?” 
সাকিব কাগজটা নিয়ে লিখতে লিখতে জিজ্ঞেস করল, “ আপনিও কি চাকরির খোজ করছেন নাকি? ” 
“ হ্যা। খুজছি। কেনো মেয়েরা চাকরি করে না?  আপনার কি ধারণা তারা বিয়ে করে শুধু সংসার করতে পারে চাকরি করতে পারে না? অবশ্যই পারে। ” 
সাকিব লিখা শেষ করে হা করে বোরকা পড়া মহিলার দিকে তাকিয়ে ছিলো। মহিলাটার বয়স কত হবে সেটা সাকিব জানে না কিন্তু কন্ঠ খুবই সুন্দর এটা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে। বোরকার দুই চোখ দিয়ে তেমন আন্দাজ করা যায় না চেহারার ধাচ। 
সাকিব কাগজটা ফেরত দিয়ে দিলো। আর বলল, “ কিছু মনে করবেন না। আপনি কি বিবাহিত?” 
“ বিবাহিত কিন্তু ডিভোর্স। ”
সাকিব এবারেও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,“ ডিভোর্স কেনো?” 
ভদ্র মহিলা কিছুক্ষণ চুপ ছিলেন। চলে যাবার আগে বলে গেলেন,' মানুষ যে কারণে বিয়ে করে,  ডিভোর্স হতেও কোনো কারণের দরকার হয় না”
ভদ্র মহিলাটি ধন্যবাদ দিয়েই রাস্তার ওপাড়ের ফুটপাতে হারিয়ে গেলেন। 

দুপুর যে কখন হয়েছে বঝতে পারেনি সাকিব। ক্ষিদার যন্ত্রণা এবার সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সকাল থেকে সেই চা আর পাউরুটি ছাড়া পেটে কিছুই পড়ে নি। এমনিতে পকেটে তেমন টাকাও নেই। সকাল থেকে যেই কাজে বের হওয়া সেই কাজের কোনো অগ্রগতি হচ্ছে বলে সাকিবের মনে হয় না। তবুও হাল ছেড়ে পিছিয়ে পড়লে চলবে না লড়াই করে যেতে হবেই। 

হুট করে দুপুরের ক্ষিদা মেটাতে এক ছোট খাটো খাবার হোটেলে বসলো সাকিব। কিছু করার নেই বেচে থাকতে হলে চাই খাদ্য চাই বাসস্থান। বাসস্থান আছে বন্ধুদের নিয়ে একসাথে থাকার জন্য এক ছোট বাসা। আর খাদ্য খেতে লাগবে টাকা। আর টাকা উপার্জনের জন্য চাই সুস্থ মস্তিষ্কের চাকরি। শুধুমাত্র সে জায়গাটায় সাকিব আটকে আছে। 

খাবার দিয়েছে মাত্র। এক প্লেট সাদা ভাত, ডাল সাথে এক বাটি সবজি। খেতে বসার অনেক্ষণ পর পাশের এক টেবিল থেকে এক লোকের ফোনকল শুনে সাকিবের কান খাড়া করেই শুনতে হলো। 
লোকটা নিশ্চিত তার প্রেমিকার সাথে ফোনকলে কথা বলছে খুবই রোমান্টিক স্বরে। কেমন সুন্দর করে কথা তার সাথে মিথ্যে কথাও বলতে হয় বোধ হয় সেটা তিনি ছাড়া আর কেউ তেমন পারেন না। সাকিব লোকটার প্লেটের দিকে তাকালো। প্লেটে শশা আর পেয়াজ কাচা মরিচ, সাদা ভাত আর ডাল ছাড়া আর কিছুই দেখল না। কিন্তু ফোনে যেভাবে সুন্দর করে ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্টের পাচ রকমের ফর্দা শুনাচ্ছিলো সাকিবের চোখই মাথার উপরে উঠে গিয়েছিলো। সবশেষে মাথা থেকে চোখ যেন মাটিতে আছড়ে পড়লো।

বিকাল হতে চলল। আকাশের রোদটাও তেমন নেই। আকাশটা বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে৷ ছোট ছোট মেঘ আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে দারুণ দৃশ্য।  ইচ্ছে করছে ক্যামেরায় বন্দি করে রাখি। কিন্ত সাকিব আবার এত শৌখিন নয়।
মাথায় কিছু বুদ্ধি ঘুরপাক খাচ্ছে সাকিবের।  এই বিকেলটা ঘুরাঘুরি করলে কেমন হয়। একা ঘুরলে তেমন মজা পাওয়া যায় না। সাথে কেউ থাকলে বেশ ভালো হতো। গল্প করা যেত, হাটা যেত, ছোট খাটো কিছু জিনিস কিনে খেতাম। টাকা খরচ হতো অবশ্য কিন্তু ভাগ করে খরচ করতাম! সবসময় তো আর অন্যের কাছে ভুরি ভুরি টাকা থাকবে না তখন? তখন নিজের টাকাই খরচ করতে হবে। তার চেয়ে বরং একা থাকাই ভালো। 

সাকিব বাকি বিকেলটা হাটতে হাটতে পার্কে এসে পড়লো। হয়তো বাকিটা সময় এখানেই কাটিয়ে দিবে। পার্কে এসেই সাকিব অন্য শৌখিন মানুষদের মতো নয় সেটা বুঝতে পারলো ভালো ভাবে। তার মতো কিছু যুবকরাও ঘুরতে এসেছে সুন্দর পোশাক পড়ে। সাকিব বেঞ্চটা ফাইল দিয়ে ময়লা ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিয়ে বেঞ্চে বসলো। পাশের বেঞ্চে তারই বয়সী এক যুবক কম বয়সী এক মেয়ের কাধে হাত দিয়ে বসে আছে। সাকিব ইচ্ছে করে তাদের দিকে অনেক্ষণ তাকিয়েছিলো। এরকম সময় হঠাৎ লোকটা সাকিবের দিকে মাথা ঘুরিয়ে বলল, “ এই যে ভদ্র লোক আপনার সমস্যা কি বলুন তো?  দেখে তো ব্যাংকের অফিসার মনে হচ্ছে!  এখনো বিয়ে টিয়ে করেননি নাকি অন্য পুরুষের স্ত্রীর দিকে তাকাতে লজ্জা করে না।” 

লোক জড়ো হবার আগেই তারা উঠে গিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। এক সুন্দরী কম বয়সী মেয়ের সামনে এক লোক এভাবে গালমন্দ করল ভেবে সাকিবের খুব খারাপই লাগছে। আবার একটু হাসিও পাচ্ছে। 
এখন সাকিবের মনে হচ্ছে তার খুবই একা একা লাগছে। চারিদিকে মানুষের প্রেম ভালোবাসা চোখে পড়লে নিজের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। 

সন্ধ্যে হবার সাথে সাথে আকাশের ছোট মেঘগুলো অনেক আগেই বোধ হয় মিশে গেছে বড় মেঘের সাথে। গাছ গাছালিগুলোর ফাঁক দিয়ে শুধু আকাশের রক্তিম লাল আভা দেখা যাচ্ছে। ক্যামেরায় বন্ধি করে রাখতে পারলে বেশ ভালো হতো৷ কিন্তু সাকিব বেকার এক যুবক। তার মধ্যে শৌখিনতা বোধ তেমন জন্মাতে পারে নি।

(সমাপ্ত)


 

কুশিও নবাব প্রিন্স
ঢাকার এক সরকারি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি। দর্শন এবং টুকরো টুকরো গল্প উপন্যাসের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তুলছি।