নানা বিশেষণে বিশেষায়িত ফজিলতুন্নেসা জোহা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী। এছাড়া বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনের ইতিহাসে তিনিই প্রথম স্নাতক ডিগ্রিধারী এবং দেশের প্রথম নারী অধ্যক্ষ। দীর্ঘদিন ঢাকার ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।  অসম্ভব মেধার অধিকারী ওয়াহেদ আলী খাঁ'র মেয়ে ফজিলতুন্নেসা ১৮৯৯ সালে ময়মনসিংহ জেলার করটিয়ার ‘কুমল্লীনামদার’ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। 


ফজিলতুন্নেসার নিজ গ্রামের করটিয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬ বছর বয়সে শিক্ষাজীবন শুরু হয়। তিনি প্রতিটি ক্লাসেই প্রথম হতেন। পারিবারিক অস্বচ্ছলতা থাকা স্বত্বেও মেয়েকে মাইনর পাস শেষে সামাজিক ও পারিবারিক বাধা অতিক্রম করে ১৯১৭ সালে ঢাকা নিয়ে আসেন তার বাবা। সে সময়ের একমাত্র সরকারি বালিকা বিদ্যালয় ইডেন স্কুলে ১৯২১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় ঢাকা বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরফলে ফজিলতুন্নেসা মাসিক ১৫ টাকা হারে বৃত্তি পান। তখন থেকে লোকের মুখে মুখে তার নাম ছড়িয়ে পড়তে খাকে। এরপর ১৯২৩ সালে ইডেন কলেজ থেকে আই.এ পাশ করেন এবং শিক্ষাবৃত্তি লাভ করেন। তারপর কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে তখনকার একমাত্র মুসলিম ছাত্রী ১৯২৫ সালে ডিসটিংশানসহ বিএ পাশ করার বিরল সম্মানের অধিকারী হন ফজিলতুন্নেসা।


তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও প্রথম মুসলিম ছাত্রী। ১৯২৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অংকশাস্ত্রে মিশ্র বিভাগে এমএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান দখল করেন ফজিলতুন্নেসা। এমএ পাশ করার পর ১৯২৮ সালে কিছুদিন তিনি ঢাকার ইডেন স্কুলে শিক্ষকতা করেন।


১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে স্টেট স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য ফজিলতুন্নেসা ইংল্যান্ড যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাবৃত্তি দিয়ে একজন মেয়েকে বিলেত পাঠাতে অস্বীকৃতি জানালে তিনি নিজ চেষ্টায় ‘স্টেটস স্কলারশীপ’ যোগাড় করেন। লন্ডন থেকে ফিরে ১৯৩০ সালে তিনি কলকাতায় প্রথমে স্কুল ইন্সপেক্টরের চাকুরিতে যোগদান এবং পরে কলকাতার বেথুন কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি এ কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান এবং একই সঙ্গে কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।


১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি বেথুন কলেজের চাকরি ছেড়ে স্বেচ্ছায় ঢাকা চলে আসেন এবং ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন। বাংলাদেশে তিনিই প্রথম নারী অধ্যক্ষ। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি ইডেন কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন। বেগম ফজিলাতুন্নেছার অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টায় বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগসহ ইডেন কলেজ ডিগ্রি পর্যায়ে উন্নীত হয়। 


ব্যক্তিগত জীবনে খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ্র পুত্র প্রথম বাঙালি সলিসিটর শামসুজ্জোহার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ফজিলতুন্নেসা। বিলেতে থাকাকালে তার সাথে শামসুজ্জোহার পরিচয় হয়। পরবর্তীতে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খার মধ্যস্থতায় জোহার সাথে ফজিলতুন্নেসার বিয়ে হয়।


১৯২৮ সালে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের দ্বিতীয় দফা ঢাকা সফরের সময় ফজিলতুন্নেসার সাথে নজরুলের পরিচয় ঘটে। কাজী মোতাহার হোসেনের লেখা থেকে জানা যায়, ফজিলতুন্নেসার বাসস্থান তখনকার ঢাকার দেওয়ান বাজারস্থ হাসিনা মঞ্জিলে গিয়ে নজরুল ফজিলতুন্নেসাকে প্রেম নিবেদন করেন। ফজিলতুন্নেসা নজরুলের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। নজরুল ফজিলতুন্নেসার বিলেত গমন উপলক্ষে ‘বর্ষা-বিদায়’ নামক একটি কবিতা লেখেন। কলকাতা ফিরে গিয়ে নজরুল ফজিলতুন্নেসাকে একটি কাব্যিক চিঠি লেখেন। সেই কাব্যিক চিঠির নাম "রহস্যময়ী"। কাজী মোতাহার হোসেন লেখেন, ‘ফজিলতের প্রতি নজরুলের অনুভূতির তীব্রতা দু’তিন বছরের সময়-সীমায় নিঃশেষিত হয়ে যায়’।


১৯৭৭ সালের ২১ অক্টোবর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন এই বিদুষী নারী। তার স্মৃতি রক্ষার্থে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৮৭ সালে তার নামে হল নির্মাণ করে।


বাংলার রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় মুসলিম মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষার পথ সুগম করেন ফজিলতুন্নেসা। নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি সম্পর্কে সওগাতসহ অনেক পত্রিকায় তার বিভিন্ন প্রবন্ধ, গল্প প্রকাশিত হয়।


ছবি ও তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া এবং ইন্টারনেট

মোঃ মোস্তফা জামান
Academician/ Scholar/ Teacher/ Lecturer