হারিয়ে যাওয়া সমুদ্রের মানুষেরা - লিখেছেন - সাবাহ বিন হুসাইন
ইতিহাস তাদের প্রকৃত পরিচয় বের করতে পারেনি আজও। তাদের মনে রেখেছে সমুদ্রের মানুষ বা Sea People হিসেবে। তাদের নিজস্ব লিখিত কোন ইতিহাসও নেই তবে তাদের শত্রুরা ঠিকই রেখেছে তাদের প্রতাপের কাহিনী।
স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকে ভাইকিংস দের প্রলয়াভিযান শুরুর ২ হাজার বছর আগে তাদের আকস্মিক আগমণ। সমুদ্রপথে প্রায় অপরাজেয় এক সামরিক শক্তির আবির্ভাব হয় ভূমধ্যসাগরে। একই সময়ে সিসিলি, তুরষ্ক, মিশর, সিরিয়া, ফিলিস্তিন সবখানে তাদের আক্রমণ চলেছে প্রচন্ডরকম।
তারা কোথা থেকে এসেছিল, কোথায়ই বা তারা হারিয়ে গেল সেই ইতিহাস নিয়ে খুব একটা কিছু এখন আর জানা যায়না। সবথেকে বেশি তাদের ব্যপারে জানত মিশরীয়রা। মিশরের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে প্রায় ২০০ বছর ধরে ক্রমাগত তাদের লংবোট এ করে আক্রমণ চালিয়েছে এই সমুদ্রের মানুষেরা। ১৩শ ক্রিস্টপূর্বাব্দে তাদের আগমণের প্রথম রেকর্ড পাওয়া যায়। আর এই সমুদ্রের মানুষদের ৬ হাজার জনকে যুদ্ধে নিহত করার দাবি করেন সমসাময়িক ফারাও মেরেনপ্টাহ্। ১১৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাদের আগমণের সর্বশেষ রেকর্ডটি করেন সেসময়ের ফারাও রামসিস তৃতীয়। তার মন্দিরের একটি সুবিশাল ওয়ালে বিস্তারিত বর্ণনা করা আছে কিভাবে নীলনদের পশ্চিম তীরে সমুদ্রের মানুষ আর মিশরীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধ হয়। ফারাও এর সৈন্যরা সফলভাবে এবং চূরান্তভাবে সমুদ্রের মানুষদের হারিয়ে দেয়। তবে এই প্রচন্ড যুদ্ধে মিশরের সাম্রাজ্য দূর্বল হয়ে পড়ে।
পরাক্রমশালী হিট্টি সাম্রাজ্যের পতন, ব্রোঞ্জ যুগের সমাপ্তি এবং অন্ধকার যুগের শুরুর অন্যতম কারণ ধরা হয় এই সমুদ্রের মানুষদের আগমনকে। তারা মিশরে নিজেদের অবস্থান গড়তে না পারলেও সিসিলিতে সরকার উৎখাত করে নিজেদের লোক বসায়, লিবিয়াতে তাদের সন্ধি স্থাপিত হয় এবং ইহুদীদের সাথে কেনান এর দখল নিয়ে যুদ্ধ হয়। ইহুদীরা পরাজিত হয় এবং তাদেরকে “Philistines” বা ফিলিস্তিনি বলে বাইবেলে উল্লেখ করা হয় [San Jose State University Research]।
ইহুদীদের হারিয়ে দিয়ে তারা বিখ্যাত Ark of Covenant এর দখল নিয়ে নেয় তবে সেটা ইহুদীদের ফিরিয়েও দেয় এক মহামারী সমুদ্রের মানুষদের জনপদে হানা দেওয়ায়। তারা এই আর্ক এর দখলকে অশুভ ধরে নিয়েছিল। সম্ভবত এখান থেকেই বর্তমান ফিলিস্তিন নামের উদ্ভব।
তাদের এই এলাকায় আসার ফলে বানিজ্যিক পথ বন্ধ হয়ে যায়। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, মিশরের সম্রাজ্যগুলোর সাথে এশিয়ার অন্য অংশের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে ব্রোঞ্জের তীব্র সংকট এবং বানিজ্যের তীব্র মন্দায় ইউরোপ এবং মিশরে ধীরে ধীরে অন্ধকার সময় ধেয়ে আসে।
তারা কোথা থেকে এসেছিল তা নিয়ে কোন ঐতিহাসিকের কাছে কোন ধারণা নেই। তবে ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরা কেউ কেউ যুক্তি দিয়ে থাকেন যে তারা সম্ভবত পরাজিত ট্রয় এর অবশিষ্ট বংশধর। গ্রীসের হাতে ট্রয়ের পতনের পর সম্ভবত নতুন বাসস্থানের আসায় অথবা তারা সরে গিয়ে অন্যত্র যেখানে আবাস গড়েছিল সেখানে তীব্র মহামারি হানা দেয়ায় বাধ্য হয়েছিল ভূমধ্যসাগরে অভিযান পরিচালনা করতে। তবে সেটা হওয়ার সম্ভাবনাও কম কেননা পুরাতন হায়ারোগ্লিফিক্স তথ্য মতে তারা কোন একক জাতি ছিল না বরং শেরদেন, পেলেসেত, ডেনয়েন, শেকেলেষ বা তার বেশি গোত্র ছিল। তবে রামসিস ৩য় এর মন্দিরের দেয়ালের এই নামগুলো থেকে তাদের উৎস জানা সম্ভব হয়নি। শুধু এতটুকু জানা গিয়েছে যে তারা উত্তর থেকে এসেছিল এবং তা দ্বারা তাদের আগমন তুরষ্ক বা তারও উত্তর থেকে বলে ধারণা করা যেতে পারে।
তবে তারা যেখান থেকেই আসুক তাদের অস্তিত্ব আর অবশিষ্ট নেই, নেই তাদের নিজেদের লিখিত কোন ইতিহাস। তবে তা একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে এমনটাও ভাববার অবসর নেই। কেননা ট্রয় এর অস্তিত্বও প্রথমে কাল্পনিক এবং পরে বাস্তব হিসেবে জানা গেছে।