প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর ব্রিটেনের নেতৃত্বে মিত্র শক্তিগুলো তুরস্কের সামগ্রিক উন্নতি রোধ করার জন্য বিবিধ অন্যায় এবং অপমানজনক নিষেধাজ্ঞা আরোপের সঙ্গে সঙ্গে তাদের পরিচয় পর্যন্ত বদলে দেয় ১৯২৩ সালে সম্পাদিত লুজান চুক্তির মাধ্যমে। তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি অটোমান সাম্রাজ্যের উৎখাতের ব্যবস্থা করা হয় এই চুক্তিতে এবং পরবর্তী ১০০ বছরেও যেন তুর্কিরা নিজেদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করার কোনো প্রচেষ্টা করতে না পারে তা সুনিশ্চিত করা হয়। ১৯২৩ সালে সম্পাদিত চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২৩ সালে। তুরস্ক মুক্তি পেতে যাচ্ছে অনেক বিধি নিষেধ এবং নিষেধাজ্ঞার হাত থেকে, তারপরে কেমন হতে পারে তুরস্কের ভবিষ্যৎ?

আপনি যখন দুর্বল ছিলেন তখন পাশের গ্রামের প্রভাবশালী লোকেরা আপনার উপর জুলুম করেছিল। আপনার জমিজমা, বাগান, পুকুর সবই দখল করে নিয়েছিল। আপনার গোয়াল ঘর থেকে হালচাষের গরুগুলোও জোর করে খুলে নিয়ে গিয়েছিল। আপনি আপনার সম্পদ রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সহায়সম্বলহীন আপনি শুধুমাত্র আপনার বসতভিটাটাই রক্ষা করতে পেরেছিলেন।

অনেকগুলো বছর পরে এসে আপনি এখন স্বাবলম্বী হয়েছেন। আপনি এখন যথেষ্ট প্রভাবশালী হয়েছেন। আপনার ক্ষমতা আছে, আপনি এখন চাইলেই আপনার উপর যারা জুলুম করেছিল তার প্রতিশোধ নিতে পারেন। এমতাবস্থায় আপনি কি করবেন?

মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে হয়ত জুলুমকারীদের ক্ষমা করে দিলেন, কিন্তু আপনার হারানো জমিজমা, সম্পত্তি, গৌরব ফিরে পেতে চাইবেন নিশ্চিত। তুরস্ক এখন ঠিক সেটাই করতে যাচ্ছে।

আমাদেরকে প্রথমেই জানতে হবে লুজান চুক্তি সম্পর্কে। হাত-পা বেঁধে তুরস্ককে ভূমধ্যসাগরে ছুড়ে ফেলে দেওয়া লুজান চুক্তি ছিল দূর্বলের উপর সবলের অত্যাচার।
   
 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজের পরাজয়ের পর ১৯২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের পরিসমাপ্তি ঘটে। জন্ম হয় সেকুলারিজম তত্ত্বে বিশ্বাসী আধুনিক তুরস্কের। ফলশ্রুতিতে, রাতারাতি মুসলিম বিশ্বের উপর কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ হারায় তুরস্ক। আধুনিক তুরস্কের গঠন, অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ও তুরস্ককে শতবৎসরের জন্য পরাশক্তি হতে না দেওয়ার জন্য সম্পাদিত হয় ঐতিহাসিক লুজান চুক্তি। লুজান চুক্তির শর্তগুলোর মূল উদ্দেশ্যই ছিল তুরস্ক যেন বিশ্বের বুকে আর মাথা তুলে না দাঁড়াতে পারে।

১৯১৯ সালের ১৮ জানুয়ারি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই প্যারিস শুরু হয়ে গেল শান্তি আলোচনা। এর ধারাবাহিকতায় সে বছরেরই ২৮ জুন প্যারিসের ভার্সাই রাজপ্রাসাদের মিরর হলে জার্মানি এবং মিত্রপক্ষের ৩২টি দেশের মধ্যে সম্পাদিত হলো ভার্সাই চুক্তি। এই চুক্তির শর্তগুলোও ছিল রীতিমত ভয়ঙ্কর। জার্মানিকে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়ার সব ব্যবস্থায় করা হয়েছিল ভার্সাই চুক্তিতে। যুদ্ধবিধ্বস্ত নিরুপায় জার্মানির পক্ষে সেই চুক্তি মেনে নেওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় ছিল না।
নিরুপায় হয়ে এই চুক্তি মেনে নিলেও জার্মান কর্তৃপক্ষ এবং জার্মান জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হলো। চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরের বছরই জার্মানিতে উত্থান ঘটে নাৎসি বিপ্লবী পার্টির। তারা দ্ব্যর্থহীনভাবে ভার্সাই চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটে। প্রতিষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা। কিন্তু ফ্যাসিবাদী হিটলারের উত্থানের মাধ্যমে বিলুপ্ত হয়ে যায় গণতান্ত্রিক সরকারও। জার্মানির গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত এবং ফ্যাসিবাদী হিটলারের অভ্যুদয়ের পেছনে এই ভার্সাই চুক্তি সরাসরি কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল। ভার্সাই চুক্তির এই অসন্তোষকে পুঁজি করে নাৎসি প্রধান হিটলার ভার্সাই চুক্তিকে অস্বীকার করেন। এসবের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট দানা বাধতে শুরু করে। এজন্য বলা হয়ে থাকে- ভার্সাই চুক্তির মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ বুনে দেয়া হয়েছিল।

এবার আসি লুজান চুক্তিতে। ১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই সুইজারল্যান্ডের লুজান শহরে স্বাক্ষরিত হয় ১ম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তকারী ঐতিহাসিক লুজান চুক্তি। অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি তুরস্কের প্রতিনিধি এবং ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান, গ্রিস, রোমানিয়া, যুগোস্লাভিয়া ও ইতালির প্রতিনিধিদের মধ্যে এ চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। লুজান চুক্তি অনুসারে একদিকে যেমন অটোমান সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য হয়ে উঠে, অন্যদিকে সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি তুরস্কের উপর আরোপ করা হয় বেশকিছু বিধিনিষেধ। ঠিক একইভাবে মিত্রশক্তি যেমন জার্মানির উপর চুক্তির বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিল।

এই চুক্তিতে তুরস্কের সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, যা বর্তমানে আধুনিক তুরস্ক হিসেবে বিদ্যমান। চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়, তুরস্ক তার আগের আরব প্রদেশগুলোর ওপর কোনো দাবি জানাতে পারবে না। আটোমান সাম্রাজ্যের আরব ও আফ্রিকান প্রদেশগুলো মিত্রপক্ষের দেশগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিবে। সাইপ্রাস ব্রিটিশদের হাতে এবং ডডেকানিজ ইতালির হাতে তুলে দেবে। অন্য দিকে মিত্ররা তাদের তুরস্কের কুর্দিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি পরিত্যাগ করবে। সাথে তুরস্ক আর্মেনিয়ার স্বত্ব ত্যাগ করবে। আর তুরস্কের ওপর প্রভাব বিস্তার করার দাবি ত্যাগ করবে মিত্র শক্তি এবং তুরস্কের আর্থিক বা সশস্ত্র বাহিনীর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ চাপাবে না। এজিয়ান সাগর এবং কৃষ্ণ সাগরের মধ্যে বসফরাস প্রণালীকে আন্তর্জাতিকিকরণ করা হবে এবং তুরস্ক এতে জাহাজ চলাচলে কোনো ফি নিতে পারবে না।

তুরস্ক এজিয়ান সাগরের সমস্ত দ্বীপপুঞ্জ গ্রীসের হাতে তুলে দিবে। এমনকি যে দ্বীপগুলো তুরস্কের ঘরের সাথে লাগোয়া সেগুলোও গ্রীস ভোগ করবে। তুরস্ক সেখানে তাদের জাহাজ ভিড়াতে পারবে না। নিজেদের দেশে কিংবা বাইরে পারবে না তেল, গ্যাস কিংবা খনিজসম্পদ অনুসন্ধান করতেও। এতদসত্বেও তুরস্কের প্রতিনিধিরা সেদিন লুজান চুক্তিতে স্বাক্ষর করে দেয়। কারণ দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া তুরস্কের সামনে আর কোনো রাস্তা খোলা ছিল না।

লুজান চুক্তির পূর্বেই ১৯২০ সালে সেভের্স চুক্তি অটোমান সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য করে তুলেছিল। যদিও এই চুক্তি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু এই চুক্তির মাধ্যমেই অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডকে ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। তুরস্ককে সাইপ্রাস, লিবিয়া, ইরাক এবং সিরিয়ার উরফা, আদানা এবং গাজিয়ানটপ কেলস এবং মার্শবাদে লেভান্টের বাকি অঞ্চলের ওপরে সার্বভৌমত্ব ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। এরও আগে ১৯১৪ সালের নভেম্বরে অটোমান সাম্রাজ্যকে মিসর ও সুদানের ওপর রাজনৈতিক ও আর্থিক অধিকার ত্যাগ করতে হয়।
       


সাম্রাজ্যের পতনের পর অটোমান সালতানাতের উত্তরাধিকাদেরকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। অনেকে নিখোঁজ হয় এবং গুপ্ত হত্যার স্বীকার হয়। লুজান চুক্তির পর তুরস্কের মোট আয়তন দাঁড়ায় মাত্র ৭ লক্ষ ৮৩ হাজার বর্গকিলোমিটার। অথচ অটোমান সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ আয়তন ছিল ৩৪ লক্ষ বর্গকিলোমিটারের বেশি। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর প্রায় ৪০টি নতুন রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটেছে।

সেভের্স চুক্তির অধীনে অটোমান সাম্রাজ্যের বেশির ভাগ অ-তুর্কি রাষ্ট্রকে স্বাধীনতা দেয়া হয়। তবে তুর্কিরা এই চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে এবং মিত্র শক্তির বিরুদ্ধে ১৯২২-১৯২৩ যুদ্ধের দুর্দান্ত জয় অর্জন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যায়। গাজী কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে চলা এই যুদ্ধ ছিল তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধ। আজকের ইস্তানবুল শহরের এমন কোনো বাড়ি ছিল না যেটা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। প্রত্যেকটি পরিবারেই ছিল একাধিক শহীদ। অবশেষে লুজান চুক্তির মাধ্যমে সবকিছুর সমাপ্তি ঘটে।

১৯১৯ সালে জার্মানির সাথে মিত্র পক্ষের ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানেই ফ্যাসিবাদী হিটলার সরকার সে চুক্তি ছুড়ে ফেলে দেয়। অথচ তুরস্ক আজও লুজান চুক্তির শর্তগুলো পালন করে যাচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে অনেক দেশের অর্থনীতি শুধুমাত্র তেলের ওপর নির্ভরশীল হলেও তুরস্ককে তেল উত্তোলন করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত রাখা হয়, ফলে তুরস্ক নিজেদের প্রয়োজনে সব রকম জ্বালানি আমদানি করে বাইরের দেশ থেকে। বুকের উপর বসবরাস প্রণালী দিয়ে চলাচলকারী হাজার হাজার জাহাজে তারা কোনো কর নির্ধারণ করতে পারে না।

আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যেকোনো চুক্তিই ১০০ বছর পরে মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। সে হিসেবে লুজান চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৩ সালের ২৪ জুলাই। স্বাভাবিক ভাবেই তুরস্ক বসবরাস প্রণালীতে জাহাজ চলাচলে কর আরোপ করবে। কৃষ্ণসাগর ও মারমারা সাগরে বৃহৎ পরিসরে জালানি অনুসন্ধান করবে। এজিয়ান সাগরে দ্বীপপুঞ্জের উপর নিজের আধিপাত্য বিস্তারের চেষ্টা করবে। মূল কথা হলো লুজান চুক্তির সকল শর্তই ভঙ্গ করতে চেষ্টা করবে।
     

ঠিক এখানেই গ্রিসের মাথা ব্যাথা। এতদিন ভোগ করে আশা এজিয়ান সাগরের দ্বীপগুলো কিছুতেই তারা হাতছাড়া করতে রাজি নয়। ইতিমধ্যে তুরস্ক পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান শুরু করে দিয়েছে। এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে গ্রিসের প্রেসিডেন্ট নিকোস আনাসতাসিয়াদেস। এদিকে গ্রিসকে সরাসরি সমর্থন করছে ফ্রান্স। এ নিয়ে ফ্রান্স এবং তুরস্কের মধ্যে চলছে এক শীতল সম্পর্ক। কিন্তু তুরস্ক ঠিকই তার পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে যাচ্ছে। আর অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তরসূরীদের এমনটা হওয়ায় স্বাভাবিক।


 

শাকিল আহমেদ
লেখালেখি আমার পেশা নয় তবে নেশা। জ্ঞানার্জনের তীব্র পিপাসা থেকেই লেখনীর সূচনা।