কালো মেয়ে - লিখেছেন - রবিউল হক বক্সী
রিথির চশমার ফ্রেমটা শুধু চেঞ্জ হয়নি। আপাদমস্তক বদলে যাওয়া রিথিকে আমি নীলফামারীতে দেখতে পাব তা স্বপ্নেও ভাবিনি। কাশ্মিরী শাল জড়ানো রিথিকে নিয়ে প্রথমত একটা রেস্টুরেন্টে বসি। গরম চায়ের ধোঁয়ার অস্পষ্টতার মাঝেও রিথির চোখের কোণায় জমে থাকা পানির অস্তিত্ব বুঝতে পারি । চায়ের কাপে মৃদু চুমুক লাগিয়ে হাসির একটা ভঙ্গি এনে রিথি বলে, সাইফুন দেখতে কখন বের হবে?
আমি ওর সমস্ত মুখমন্ডলের দিকে চেয়ে থাকি। দীর্ঘ তিন বছর পর ওকে দেখছি, ওর শরীরের মৃদু একটা ঘ্রাণ আছে- এগ্রিভার্সিটির প্রথম কয়েকটা বছর রিথি পড়াশোনায় এমন সিরিয়াস ছিল যে লাইব্রেরিতে ওর পাশে বসে স্টাডি করতাম সেই ঘ্রাণের বিনিময়ে।
রিথি হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলে, চল তোমার বাসায় যাব।
- আমার বাসা নেই রিথি, আমি মেসে থাকি। মেসে গেলে তোমার ভালো লাগবে না, তাছাড়া তোমাকে আমাকে নিয়ে সকলেই হাসাহাসি করবে।
জেদি গলায় রিথি বলল, হাসবে কেন? আমি যাব যে!
অগত্যা নিয়ে যেতে হল। আমার রুমে ঢুকে রিথি স্তম্ভিত হয়ে গেল, দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ।
- সত্যি কি তুমি এখানে থাকো? এখানে কোন মানুষ থাকতে পারে?
মেসে শোরগোল পড়ে গেলো, আমার সেই ম্যাজিস্ট্রেট বান্ধবী এসেছে বলে। দু’একজন উঁকি দিতেই রিথি তাদের সাথে পরিচিত হয়ে গেলো। অন্যদের সাথে রিথি যখন কথা বলছিলো তখন ওর ব্যাক্তিত্ব ঠিকরে পড়ছিল। কে বলবে এগ্রিভার্সিটির ক্যাম্পাস ছেড়ে প্রায় বিকালে আমরা শম্ভুগঞ্জ ব্রিজে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখতাম। ব্রিজ থেকে দুজনেই একসাথে থু ফেলতাম ব্রহ্মপুত্র নদের উপর, কিন্তু আশ্চর্য যে, পানিতে একসাথে থু পড়ত না। শেষ মুহূর্তে বাতাস একটা ব্যবধান তৈরি করত।
কথা বলার সাথে সাথে রুমটা গুছাতে লাগল রিথি- রুমে এত বোতল কেন, অর্ধেক পানিতে বোতল গুলো হলুদ হয়ে গেছে এগুলো ফেল না কেন, পাচঁটা ব্রাশ দিয়ে নিশ্চয়ই দাঁত মাজ না, বাকি গুলো ফেলছ না কেন, তোমার রুমে যা আছে তার অর্ধেকেই ফেলে দেয়ার মত অথচ এগুলো আগলে রাখছো, সত্যি করে বলো তো তোমার অফিসেও তুমি কি এমন অগোছালো?
আমি সাইফুন দেখতে যাওয়ার জন্য রিথিকে তাড়া দিতে থাকি। মেসের ছোট্ট উঠোনে শীতের দুপুরের রোদে রিথি যখন কিছুক্ষণ দাঁড়ায়, হঠাৎ আমার মনে হয় শ্যামলা ত্বকের সজীব রিথি কার দখলে যাবে? কার এমন সৌভাগ্য!
ভার্সিটিতে থাকতে রিথি সর্বদা বলত, আমি কালো আমাকে কে বিয়ে করবে ?
বোকার মত আমি বলতাম, আমি বিয়ে করব।
রিথি অট্টহাসিতে বলত, তুমি এক ফর্সা মেয়েকে বিয়ে কোরো, আমাকে না।
নীলফামারী থেকে চান্দের হাটের দিকে ইজি বাইকে এগুতে থাকি। শীতের রুক্ষ বাতাস বইছিলো, রিথি লোশন বের করে আমাকে বলে, হাত-মুখে দাও, ভালো লাগবে। এবার চান্দের হাট থেকে লেকের পাড় ঘেসে রিক্সা নিয়ে এগুতে থাকি। একসময় সাইফুন এসে যায়।
রিথি অবাক হয়ে দেখে নীচ দিয়ে নদী আর তার উপর দিয়ে উত্তর দক্ষিনে সোজাসোজি চলে গেছে লেক। অথচ লেক আর নদীর পানি আলাদা ধারায় প্রবাহিত, কোনটার সাথে কোনটার পানি মিশতে পারছে না। নদীর উপর দিয়ে বিশাল এক ব্রিজের মত করে লেকটাকে আলাদাভাবে ব্রিজের উপর দিয়ে প্রবাহিত করা হয়েছে।
রিথি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলে, পুরো বিষয়টা অনেক কষ্টের এটা অনুভব করতে পারছো?
- কেনো, নদীর পানি লেকের পানির সাথে মিশতে পারছে না বলে?
- হু, মনে হচ্ছে লেকটা নদীটার শুধু ভার্চুয়াল ফ্রেন্ড, কোন রিয়েলিটি নেই।
- সত্যি, রিথি, বিষয়টা অনেক কষ্টের।
- এখানে আর বেশিক্ষণ থাকবো না, থাকতে ভালো লাগছে না, চলো যাই।
রিক্সা চান্দের হাটের দিকে এগুতে থাকে। চারপাশে বিস্তির্ণ সবুজ ধান ক্ষেত, শীতের দূরন্ত সূর্যটা গোধূলীকে সন্ধ্যা বানাতে দ্রুত এগিয়ে চলে। গোধূলীর মৃদু আলো রিথিকে অপার্থিব অপ্সরী করে তোলে। আমার হঠাৎ মনে হয়, আমার সম্পর্কে রিথির সত্যিকার মনোভাবটা আমার জানা দরকার।
আমি বলি, রিথি তোমার একটা হাত হাতে নেই?
রিথি দৃঢ় গলায় বলে, না।
তারপর রিক্সা থেকে নিজেও যেন একটু সরে যায়। আমরা বেশ কিছুক্ষণ কথা বলি না।
কিছুক্ষণ পর আমি ওকে বলি, স্যরি রিথি, আমার ভুল হয়ে গেছে। এমনটা বলা আমার ঠিক হয়নি।
আমার চোখে রিথি তাকিয়ে বলে, আমি নীলফামারীতে আসায় তুমি কি খুশি হয়েছ?
- সত্যি অনেক খুশি হয়েছি, ব্যাংকে একটা প্রমোশন হলেও এমন খুশি হতাম না।
রিথি আমার চোখে তাকিয়ে কেঁদে ফেলে, এই কালো মেয়েটা যদি তোমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আর যদি না ছাড়ে তখনও কি তুমি এরকম ভালবাসতে পারবে?
- তোমাকে যে কত ভালবাসি তা তুমি জানো, কালো নিয়ে অনেক বড়াই করেছ তুমি, আর নয়.. .. আমাকে আর কষ্ট দিও না।
বোবা হাসিতে রিথি বলে, আমি বড়াই করেছি?
- হ্যাঁ, তুমি কালো এটা নিয়ে খুব বড়াই কর।
রিথি খিলখিল করে হেসে ওঠে ওর হাতটা এগিয়ে দেয়। এই সেই হাত! আমি রীতিমত কাঁপতে থাকি।
ডুবন্ত সূর্যের বুক দিয়ে কয়েকটা পাখি উড়ে যায়, গোধূলীর নরম আলোয় চারপাশটা ছবির মত লাগে। কালো মেয়েটা আলতো করে আমার কাঁধে ওর মাথাটা রাখে। বুঝতে পারি, ওর চোখের পানিতে আমার কাঁধ ভিজে যাচ্ছে।