রঙবেরঙ - লিখেছেন - মণীষা মহাজন
১.
মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মোছড়ানো কাগজগুলো। আবিরকে ঊনপঞ্চাশতম চিঠি লিখতে বসে মোটমাট বারোটা কাগজ ছিঁড়ে মেঝেতে ছুড়ে ফেলেছে অনিতা। একটা চিঠিও মনমতো হচ্ছেনা। যা বলতে চাইছে তা বলা হচ্ছেনা, অপ্রয়োজনীয় কথা এসে পরছে। বিরক্তিমাখা মুখে তেরোনম্বর কাগজ নিয়ে আবার লিখতে বসে অনিতা।
আবিরদা,
কাকাবাবু জানিয়েছে তোমার পড়াশোনা নাকি শেষ হয়েছে। বাড়ি ফিরে আসছো। একথা শোনার পর থেকে আর যেন তর সইছেনা। এতবছর না দেখে থেকেছি, আর এই কয়টা দিন থাকতে পারছিনা, আচ্ছা এমন কেন হয় বলোতো? তোমার কি এমন হয় আবিরদা? তোমাকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছেগো। সেবার বলেছিলাম একটা ছবি পাঠাতে। তুমি পাঠালেনা। বোঝোনা কেন তুমি? চোখের যে আমার বড্ড তৃষ্ণা পায় , তৃপ্তি তোমাতেই। কবে আসবে তুমি আবিরদা। তাড়াতাড়ি এসো।
ইতি তোমার
অনি
চিঠিটা লিখা শেষ করে একটা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে অনিতা। সোজা সাপটা যা বলার বলা হয়েছে, অপ্রয়োজনীয় কথা আসেনি। মনমতো হয়েছে চিঠিটা। হরিপদকে ডেকে চিঠিটা তার হাতে দিয়ে পোস্ট করে দিতে বললো অনিতা।
বিকেলের আকাশজুড়ে ঝাঁক বেঁধে আছে সাদারঙা মেঘ, মেঘের ফাঁকে নজরে পড়ছে নীলচে রঙের আকাশ। কি যে সুন্দর লাগছে! একটা একলা একা চিল উড়ছে আকাশে। সেদিক পানে চেয়ে রইলো অনিতা। চিলটা অনেকদূর গেলে ঝাপসা হয়ে আসে তার দেহের আদল, চোখের সামনে ধরা দেয় সেসব দৃশ্যগুলো।
একবিকেলে অনিতার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেবেন্দ্র রায় হাজির হন অনিতাদের বাড়ি। সেই দেবেন্দ্রবাবুর ছেলে আবির। আবিরকে কলেজে ভর্তি করাতেই সেদিন বিকেলে ঢাকায় এসে ছেলেকে নিয়ে অনিতাদের বাসায় উঠেন তিনি। আবিরের কলেজ তাদের গ্রাম থেকে অনেক দূরে হওয়ায় দেবেন্দ্রবাবু বন্ধুর বাড়ি ছেলেকে রেখে যাওয়ার ইচ্ছাপোষণ করেন। এতে অনিতার বাবা আপত্তি করেননা। সেই থেকে প্রায় তিনবছর ছিল আবির অনিতাদের বাড়ি। পরবর্তীতে রাজশাহী ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ায় রাজশাহী পাড়ি জমায় আবির। গত কয়েকবছর যাবত ওখানেই আছে সে।
আবির রাজশাহী যাওয়ার আগের সময়গুলো স্বপ্নের মতো কাটে অনিতার। অল্পদিনেই ভাব হয়ে যায় দুজনার। ভালো লাগতে শুরু করে আবিরকে, তারপর ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা এতোদিন যাবত মনগহীনে পুষছে অনিতা।
- "অনি, এই অনি, অনিতা"
ডাকতে ডাকতে অনিতার ঘরে ঢোকেন অনিতার মা মিথিলা।
- "এইযে অনি"
- "হ্যাঁ,মা"__মার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে জবাব দিলো অনিতা।
- "বলছি যা না ক'টা বেলপাতা পেড়ে আননা মন্দিরের সামনে থেকে, কাল যে শিবপূজা"
- "আচ্ছা যাচ্ছি মা"
কোমড়ে আঁচল গুঁজে বেরিয়ে পরে অনিতা বেলপাতা পাড়তে। ডেকে নেয় মন্টু, চিংকু, শিবুকেও। এরা পাড়ার ছোট ছোট বাচ্চা। বয়সে তাদের থেকে অনেক বড় অনিতা। তবুও পাড়ার ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথেই বেশি ভাব অনিতার।
তাদেরকে সাথে নিয়ে বেলপাতা পেড়ে আনে অনিতা। সেগুলা নিয়ে ঠাকুরঘরে রাখতে রাখতে অনিতা বললো,
- "এইযে এখানে রাখলাম মা"
- "রাখ। শুনেছিস অনি?"
- "কী মা?"
- "আবির আসছে যে কাল"
- "কাল!"
- "তাইতো চিঠিতে লিখেছেন দেবেন্দ্রবাবু। সে নাকি গতকাল এসেছে তাদের গ্রামের বাড়ি। কাল শিবপূজোয় আসবে এখানে। কত...
বাকি কথা কানে ঢোকেনা অনিতার। একধরনের শিহরণ বয়ে যায় সারা শরীরে, আনন্দের ঢেউ খেলে যায় মনে। দৌড়ে নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বালিশে মুখ গুঁজে দেয় সে।
২.
পূজার যোগারপাতি সব করে ঘরে গিয়ে পরনের জামাটা পালটে কাঁচা হলুদ রঙা একটা শাড়ি পরে নেয় অনিতা। চুলগুলা কোনোমতে আঁচড়িয়ে খোলা ছেড়ে দেয়। নয়টা বাজতে যে আর বেশি দেরী নেই। ঠাকুরমশায় এলো বলে। আঁচলটা কোমড়ে গুঁজে তড়িঘড়ি করে বেরোতে গিয়ে দরজার কাছে এসে মুখোমুখি হয় আবিরের। সে আজ সকালে এসেছে। আসছে অবদি আবিরের সাথে কথায় হয়নি অনিতার, দেখেওনি ভালো করে। এতবছর পর আবিরকে এতো কাছাকাছি দেখে হালকা কেঁপে উঠলো অনিতা।
- "কেমন আছিস অনি?"
- "ভা...ভালো"
- "একটা কাজ ছিল অনি"__ বলে পকেটে হাত দিয়ে কি যেন একটা বের করে অনিতার দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বললো,
- "ধর এটা নে"
- "কী এটা?"
- "ধরনা"
অনিতা খামটা হাতে নিলে আবির বললো,
- "যাইরে, খুলে দেখিস"
বলে বাইরে থেকেই চলে গেলো আবির।
খামটা খুলে অনিতা দুটো চিঠি পেলো। আবিরদার চিঠি! কেমন যেন করে উঠলো অনিতার ভেতরটা।
অনিতা,
চিঠিটা অথৈকে দিয়ে দিস প্লিজ। অথৈকেতো চিনিস। পাশের বাড়ির রমেশ কাকার মেয়ে। আমার সাথে রাজশাহী ভার্সিটিতেই পড়ে অথৈ। আমার একব্যাচ জুনিয়র। পাড়াতে থাকতে চিনতামনা তাকে। ভার্সিটিতেই পরিচয়, তারপর ভালোলাগা, প্রেম। পনেরোদিন আগে বাড়ি এসেছে সে। এতোদিন দেখা, কথা কিছুই হয়নি। বুঝতেইতো পারছিস। আমি গেলে কেলেঙ্কারি বেঁধে যাবে। ওর ফোনও নেই। দিয়ে আসিস প্লিজ।
আবির।
ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো অনিতা। দ্বিতীয় চিঠিটা খোলার অবস্থাতেই রইলোনা সে। চোখের কোণ ঘেঁষে জল গড়িয়ে পরতে লাগলো অনবরত। কি হলো এটা! আবিরদা কি করলো এটা! কেন করলো? আবিরদা কি কখনো তার ভালোবাসা বুঝতে পারেনি? অবশ্য বুঝবে কি করে আবির? সে নিজেতো কখনোই তার ভালোবাসা প্রকাশ করেনি।
- "আচ্ছা তার চিঠিতে কি কখনোই ভালোবাসা প্রকাশ পেতোনা?" -নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো অনিতা।
- "না হয়তো, ভালোবাসা জিনিসটা সরাসরি প্রকাশ করতে হয়। মুখ ফুটে না বললে বুক ছিঁড়ে গেলেও কেউ বুঝতে পারেনা"
নিচ থেকে ডাকছে।
- "অনিতা, এ্যাই অনি, ঠাকুরমশাই চলে এলো যে। শীঘ্রই আয়"
কান্নাভেজা কন্ঠে অনিতা বললো,
- "আসছি মা"
গলা বুজে এলো তার। চোখ মুছে মুখ ধুয়ে নীচে গিয়ে কাজে লেগে পরলো অনিতা। সেই হাসিখুশি চঞ্চল অনিতার ভালোবাসাটা রয়ে গেল বুকের ভেতর সংগোপনে, সকলের অগোচরে, কাকপক্ষীও টের পেলোনা তা।