নিত্যদিনের বিজ্ঞানঃ টেলিভিশন (১ম পর্ব) - লিখেছেন - আনাস রোহান
সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে যখন আমরা ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত তখন একটুখানি বিনোদন আমাদেরকে আবার সজীব করে তুলতে পারে। আর এ লকডাউন সময়ে তো অধিকাংশ সময় আমরা বিনোদনেই কাটিয়ে দেই। অন্তত আমি। সময়ের সাথে সাথে যদিও বিনোদনের প্রকার এবং মাধ্যমে পরিবর্তন এসেছে, তারপরও এটি প্রায় সবাই স্বীকার করে নেবে যে বিনোদন মাধ্যম হিসেবে টেলিভিশন সবসময়ই প্রথম দিকে থাকবে। আজ আমরা চারপাশে অনেক রকমের টিভি দেখতে পাই। কারোটা এলইডি, কারোটা এলসিডি কিংবা ওলেড, আবার কেউবা বিনোদনকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে থ্রিডি টিভি দিয়ে। কিন্তু আমরা কি জানি এ টিভি কিভাবে আবিস্কৃত হলো বা এটি কিভাবেই বা কাজ করে? নিজের কৌতূহল কে নিবারণের জন্য হলেও চলুন জেনে নিই।
টেলিভিশন শব্দটি গ্রিক শব্দ টেলি যার অর্থ দুরে এবং ভিশিও যার অর্থ দেখা থেকে এসেছে। ১৯০০ সালের দিকে রাশিয়ান বিজ্ঞানি কনস্ট্যাটিন পার্সকি এটি প্রথম ব্যবহার করেন তার একটি গবেষনাপত্রে যা তিনি তৈরি করেছিলেম ফ্রান্সে প্রথম আন্তর্জাতিক বিদ্যুৎ সম্মেলনের জন্য। তারপর থেকে এটি ব্যবহার হয়ে আসছে।
১৮৮০-১৮৯০ এর মধ্যে জার্মান আবিষ্কারক পল গটিলেব নিপকো সর্বপ্রথম টেলিভিশনের ধারনা দেন। যদিও সেটি আজকালকার মত ইলেকট্রিক ছিলো না, সেটি ছিলো যান্ত্রিক। একটি ঘূর্নায়মান ডিস্কের মধ্যে সর্পিলাকারে ছিদ্র করে তার মধ্য দিয়ে আলো পাঠিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছিল। তিনি এটির নাম টেলিভিশন না দিয়ে দিলেন "ইলেকট্রিক টেলিস্কোপ"।
১৯২০ এর পরের দিকে স্কটিশ আবিষ্কারক লজি বেয়ার্ড এবং আমেরিকার আবিষ্কারক চার্লস ফ্রান্সিস জেনকিনস আলাদাভাবে নিপকো এর ব্যাবস্থাটিকে উন্নত করে যান্ত্রিক টেলিভিশন তৈরি করেন। প্রথম দিকের এ টিভি গুলো খুবই সাধারণ ছিলো। যান্ত্রিকভাবে ছবি স্ক্যান করতো এবং তা স্ক্রিনে নিক্ষেপ করতো।
যান্ত্রিক টিভি কাজ করে কিভাবে-
আগেই বলেছি যান্ত্রিক টিভি কাজ করে ঘূর্নায়মান ডিস্কের সাহায্যে। টিভির দুটি প্রান্ত থাকে- একটি হলো প্রেরক অংশ, আরেকটি হল গ্রাহক অংশ। উভয় অংশেই একটি করে ডিস্ক থাকে। ডিস্কগুলোর মধ্যে সর্পিলাকারে ছিদ্র করা থাকে একটির নিচে একটি। একটি মোটরে এ ডিস্ক লাগিয়ে তাকে ঘুরানো হয় এমন ভাবে যে ডিস্কের একটি পূর্ণ আবর্তন টিভির একটি ছবির ফ্রেমের সমান হয়। উভয় অংশের ডিস্ক সমান গতিতে ঘুরে। লজি বেয়ার্ডের টিভির ডিস্কে ৩০ টি ছিদ্র ছিলো এবং তা ১২.৫ বার ঘুরতো প্রতি সেকেন্ডে।
প্রেরক ডিস্কটির পিছনে একটি উজ্জল আলোর উৎস থাকে এবং ডিস্কটির সামনে লক্ষ্যবস্তু (যাকে গ্রাহক অংশে দেখানো হবে) থাকে। লক্ষ্যবস্তু এর আশপাশ অন্ধকার করে রাখা হয়। ডিস্কটির পিছনের আলোর উৎস থেকে আলো ছিদ্র দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে যায় এবং লক্ষ্যবস্তু থেকে আলো প্রতিফলিত হয়। লক্ষ্যবস্তুর কালো অংশ কম আলো প্রতিফলিত করে আর কিছুটা উজ্জল অংশ বেশি আলো প্রতিফলিত করে। এ প্রতিফলিত আলো একটি ফটোসেল এ গিয়ে পড়ে। ফটোসেল হলো এক ধরনের কোষ, যা আলোকশক্তিকে বিদ্যুতে রুপান্তর করে। ফটোসেলটি লক্ষ্যবস্তু থেকে আসা আলোকে বৈদ্যুতিক তাড়নায় রুপান্তর করে। আলোর পরিমানের উপর ভিত্তি করে বিদ্যুৎ তাড়না কম বেশি হয় এবং এ তাড়না রেকটিফায়ার, ট্রান্সমিটার দিয়ে রেডিও সিগন্যালে রুপান্তর করে।
অপরপাশে কিন্তু আমাদের গ্রাহকও তেমনি রেডিং সিগন্যাল রিসিভার নিয়ে বসে আছে। এ রিসিভার সিগন্যাল গ্রহন করে এবং তা একটি নিওন বাতিতে পাঠায়। এ নিওন বাতিটি গ্রাহক অংশের ঘূর্ণায়মাণ ডিস্কের পিছনে থাকে। বৈদ্যুতিক সিগনালের উপর ভিত্তি করে নিওন বাতি সমানুপাতে আলো দেয় যা লক্ষ্যবস্তুর উজ্জল অংশের জন্য বেশি ও কম উজ্জল অংশের জন্য কম। এটি ডিস্কের অপরপাশে ম্যাগনিফায়িং গ্লাসের মাধ্যমে দর্শক দেখতে পায়।
এভাবেই প্রথমদিককার যান্ত্রিক টেলিভিশন কাজ করতো।
বৈদ্যুতিক টেলিভিশনঃ যান্ত্রিক টেলিভিশন অতটা সহজ ছিলো না ভোক্তা পর্যায়ে নিয়ে আসা এবং সহজভাবে ব্যবহার করার। এ সমস্যা টি দুর হয় বৈদ্যুতিক টেলিভিশন এর দ্বারা। প্রথম বৈদ্যুতিক টিভি তৈরি করেন ২১ বছর বয়সী উদ্ভাবক ফিলো টেলর ফ্রান্সওর্থ। তিনি চলমান ছবিগুলোকে ধারন করে তাদের কোডে রুপান্তর করে রেডিও সিগনাল এর মাধ্যমে অপর কোনো যন্ত্রতে পাঠানোর চিন্তা করেন।
সবদিক দিয়ে বৈদ্যুতিক টেলিভিশন যান্ত্রিক টেলিভিশন থেকে উন্নত ছিলো। যা বিশ্বব্যাপি টেলিভিশনের ধারনাকেই পাল্টে দেয়। সর্বপ্রথম ফান্সওর্থ তার বৈদ্যুতিক টিভি দিয়ে একটি সাধারন রেখা প্রেরন করে দেখান। পরবর্তীতে তিনি একটি ডলার সাইন প্রেরন করেন। তবে ফ্রান্সওর্থের টিভি রঙিন ছিল না। সর্বপ্রথম রঙিন টেলিভিশন এর ধারনা দিয়ে তার প্যাটেন্ট করিয়ে নেন ভ্লাদিমির জোরিকিন ১৯২৫ সালে। যদিও তার পদ্ধতিকে বাস্তবে রূপান্তর করা যায়নি কখনোই।
বৈদ্যুতিক টেলিভিশন কাজ করে কিভাবে-
বর্তমানে আমরা যতধরনের টেলিভিশন ব্যবহার করি তার সবগুলোই হল বৈদ্যুতিক। সিআরটি, এলইডি, এলসিডি, প্লাজমা, ওএলইডি সবই বৈদ্যুতিক টেলিভিশন। তবে তাদের কার্যপ্রনালী ভিন্ন ভিন্ন। প্রথমেই আমরা সিআরটি এর কার্যপ্রনালী জানবো।
সিআরটি টেলিভিশনঃ মনে আছে আমাদের সবার বাসায় একটা বক্সের মত ভারী টিভি ছিলো? যদিও এখনো অনেকের বাসায়ই আছে, সেগুলোই হল সিআরটি (ক্যাথোড রে টিউব) টেলিভিশন। বর্তমানে আর বেশি দেখা যায় না এ ধরনের টেলিভিশন। তবে ১৯৩৪ থেকে প্রায় ২০১০ পর্যন্ত টিকে ছিলো এ ধরনের টিভি। সাধারনত টেলিভিশনের পর্দায় আমরা যে চলমান ছবি দেখি তা আসলে চলমান নয়। অতি অল্প সময়ে (১ সেকেন্ডে) প্রায় ২৪ টির মত স্থিরচিত্র দেখানো হয় যা আমাদের চোখে চলমান বলে মনে হয়। টেলিভিশন স্টেশনের একটি ক্যামেরায় ছবিগুলোকে ধারণ করা হয় এবং সাথে সাথে একটি মাইক্রোফোনে শব্দ ধারন করা হয়। এ ছবি ও শব্দকে রেডিও সিগনালে পরিনত করে এন্টেনার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়। আমরা আমাদের বাসার এন্টেনার মাধ্যমে সে সিগনাল গুলো গ্রহন করি এবং তা টেলিভিশনের মধ্যে যায়। সেখানে একটি ইলেকট্রিক সার্কিট শব্দের সিগনাল ও ছবির সিগনালগুলোকে আলাদা করে ফেলে। শব্দের সিগনালগুলো স্পিকারে যায় যা টেলিভিশনের সামনে থাকে বা পাশে, যার দ্বারা আমরা শব্দ শুনতে পাই। অন্যদিকে ছবির সিগনাল গুলো যায় আরেকটি ইলেকট্রনিক সার্কিটে যা লাগানো থাকে একটি কাচের টিউবের পিছনে। আমরা আমাদের টিভির পিছনে আগে এরকম টিউব দেখতে পেতাম যাকে আমরা পিকচার টিউব বলি। মূলত এ টিউব টি হলো বায়ুশূন্য একটি ক্যাথোড টিউব। যার একপাশে একটি ফিলামেন্ট থাকে সে ফিলামেন্টে বৈদ্যুতিক ভাবে তাপ উৎপন্ন করলে তার থেকে ক্যাথোড রশ্মি বের হয়। এ ফিলামেন্টকে ইলেকট্রন গান ও বলা যায়। এ ক্যাথোড রশ্নি মূলত ইলেকট্রনের প্রবাহ। পিকচার টিউবের অপর পাশে টেলিভিশনের স্ক্রিনের কাছে থাকে অনেকগুলো অ্যানোড যা হলো ধনা্ত্মক। ফলে যখন ফিলামেন্ট থেকে ক্যাথোড রশ্মি বের হয় তা ঋনাত্নক হওয়ায় তা (বিপরীতধর্মী চার্য পরস্পরকে আকর্ষন করে) অ্যানোডের দিকে ধাবিত হয়। অর্থাৎ ইলেকট্রনগুলো স্ক্রিনের উপর গিয়ে পড়ে।
স্ক্রিনের উপর গিয়ে পড়লেই ছবি তৈরি হয় না। এর জন্য স্ক্রিনের পিছনে ফসফর এর প্রলেপ দিতে হয়। ফসফর হল সেসব পদার্থ যারা শক্তি শোষন করে দৃশ্যমান আলোর বর্ণালিতে আলো উৎপন্ন করতে পারে। মূলত ইলেকট্রন যখন ফসফরে আঘাত করে তখন ফসফরে শক্তি উৎপন্ন হয়, যার ফলে তার নিজস্ব শেষ স্তরের ইলেকট্রন উচ্চ শক্তিস্তরে আরোহন করে। কিন্তু এ আরোহন ক্ষণস্থায়ী, অতি অল্প সময়ের মধ্যে ইলেক্ট্রন আবার নিজস্ব কক্ষপথে চলে আসে। একে অবরোহন বলে। ইলেকট্রন আরোহনে শক্তি শোষিত হয় আর অবরোহনে শক্তি নির্গত হয়। ফলে ফসফর থেকে দৃশ্যমান আলোর বর্নালিতে শক্তি নির্গত হয় যা আমরা দেখতে পাই।
তবে ইলেকট্রন গুলো স্ক্রিনের কোন জায়গার ফসফরকে আঘাত করবে তা নিয়ন্ত্রণ করা হয় একটি স্টিয়ারিং কয়েল দিয়ে। এটি হলো চৌম্বক ক্ষেত্র সৃষ্টকারী কয়েল। যা ইলেক্ট্রনগুলোকে পাশাপাশি উপরনিচ যেতে সাহায্য করে তার চৌম্বক ক্ষেত্রের দ্বারা। এভাবে স্ক্রিনের বিভিন্ন জায়গায় আলোর কমবেশির দ্বারা আমরা ছবিটি দেখতে পাই।
সাদা কালো টিভিতে এক ধরনেরই ফসফোর ব্যবহার করা হয়। রঙিন টিভিতে লাল, সবুজ, নীল আলো সৃষ্টিকারী আলাদা ফসফর ব্যবহার করা হয়। ফলে পুরো স্ক্রিন জুড়ে এ আলোর তারতম্যের উপর ভিত্তি করে ছবি দেখতে পাই আমরা।
আশা করি লেখাটি আপনাদের ভালো লেগেছে। আগামী পর্বে এলইডি, এলসিডি টেলিভিশনের কার্যপ্রণালি নিয়ে আলোচনা হবে। সবাই ভালো থাকবেন।
শুভকামনা।
(এটি একটি সিরিজ। যেখানে আমি আমাদের নিত্য ব্যবহার্য যন্ত্রগুলোর ইতিহাস,কার্যপ্রনালী তুলে ধরার চেষ্টা করব। আপনাদের মূল্যবান মতামত তুলে ধরবেন)